জীবন-নাটক

আমার সেই গহীন ছোটবেলার সবচেয়ে উত্তেজনাময় যে স্মৃতিটি আমার মনে পড়ে সেটি আমাকে আজো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ঠিক কি উপলক্ষে আজ আর মনে পড়ে না, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়-এর একটা বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল। রীতিমত মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল বেঁধে। সেই উপলক্ষে প্রচুর বক্তৃতা আর নাচ-গান-আবৃত্তির সাথে একটা নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল। রবিবুড়োর ডাকঘর থেকে একটা ছোট্ট অংশ ছিল আমাদের পাঠ্যবইয়ে, অমল ও দইওআলা শিরোণামে। দিদিমণিরা সেটাই বেছে নিলেন মঞ্চস্থ করার জন্য। সম্ভবত: প্রচুর পটর-পটর করার যোগ্যতায় আমি মনোনীত হলাম অমল-এর ভূমিকায়। চতুর্থ শ্রেণীর এক শ্রীমান হল দইওআলা।

সেই প্রথম জানলাম রিহার্সাল কাকে বলে। শেষ ক্লাস-এর পরে শুরু হত। ভাল লাগত, তবে একটু ক্লান্ত হয়ে যেতাম – আমার তো কবে সব মুখস্ত হয়ে গেছে, ভাব ভঙ্গী সহ! শুধু একটাই আশায় আশায় চালিয়ে যেতাম – আমার ধারণা হয়েছিল যে ভালভাবে করতে পারলে আসল অনুষ্ঠানের দিন আমাকে দইওআলা ছেলেটির হাত দিয়ে একটা সত্যি দই-য়ের ভাঁড় দেওয়া হবে। সেটা নিয়ে কি যে উত্তেজিত থাকছিলাম!

এসে গেল দিনটা। আমরা কলা-কুশলীরা প্রথম থেকেই গ্রীনরুম-এ। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছি – সামনে মাথার পর মাথা, লোকের পর লোক। কালে কালে সম্ভাব্যতার যুক্তিতে সে সমাবেশের আকার ছোট থেকে ছোটতর হয়েছে, কিন্তু অন্তরের অন্ত:পুরে সেটা বিশাল-ই রয়ে গেছে।আমার চেতনায় সেটিই ছিল জনসমুদ্রের প্রথম ধারণা। মজার বিষয়, সেই জনসমুদ্র দেখে আমার কোন ভয় বা দ্বিধা হল না। বরং নিজের ভিতর থেকে একটা অজানা শক্তির জেগে ওঠা টের পেলাম। সেদিনের সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে বারে, বারে – যতবার মঞ্চে উঠেছি ততবার। লাইম লাইটের আলোয় আমি অন্য মানুষ – আমি-ই তখন নিয়ন্তা।

কুচো ফর্মাটের সেই নিয়ন্তা একসময় মঞ্চে এসে বসল, ঘরের ভিতর জানালার পাশে। বসেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। এটা একটা মঞ্চ সজ্জা হল! আমার সামনে হাঁটুর উচ্চতায় একটা কাপড়ের বেড়া আর তার সাথে উল্লম্ব অবস্থান-এ দুটো কাপড়ের আড়াল আমার দু’পাশে। একটা চৌখুপী। এটা একটা জানালা হল! একসময় মাইক্রোফোন ঠিক করা হল। আমাকে বলা হল টেস্ট করতে। করলাম। মনে হল সামনে বড্ড আওয়াজ। গোলমালের সমুদ্র চলছে যেন। ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়-ই ছোট বাচ্চারা বেশী কথা বলছে। আগেও কয়েকবার এই অবস্থায় যে ঘোষণাটি শোনা গেছে এবার আমি-ই সেটি দিয়ে দিলাম, সঙ্গে দিলাম নাটক শুরু করার বার্তা – বাচ্চারা, গোলমাল না করে চুপ করে বসে পড়, আমাদের নাটক এখন-ই শুরু হবে।

ব্যাস! জনসমুদ্র যেন হো হো হাসির গর্জন-এ ফেটে পড়ল। এক মাস্টারমশাই উইংসের আড়াল থেকে ছুটে এসে আমায় বললেন এখন-ও যেন মাইকে কিছু না বলি। আমি ত হতবাক! দোষটা কি করলাম! পরে বুঝেছি, মহা দোষ করেছিলাম। শান্ত ভাবে, উচ্চকিত আড্ডার কলতানে চারিদিক মথিত না করে অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করাটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। গোলমাল তো আর বাচ্চারা ততটা করছিলনা, যতটা করছিল বড়ররা! তাই আমার তিরস্কার আসলে বিঁধেছে তাদের-ই। অতএব উপহাস আর মজার উল্লাসে আমার দোষের শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কি-ই বা তারা করতে পারতেন, এমন কি গোটা উপমহাদেশ জুড়েই আজো পারেন! আর একটা আঘাত-ও সইতে হল – দই-এর ভাঁড়-এ কোন দই ছিল না! দই-জনিত সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বড়ররা হয়ত ঠিক ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন, কিন্তু নাটক শেষের হাততালির ঝড়-ও আমার ক্ষোভ আর অপ্রাপ্তির দু:খ মুছে দিতে পারে নি। সেই সন্ধ্যায় আমি প্রস্তুতি ছাড়াই একদফা বড় হয়ে গিয়েছিলাম!

নিজে করার পাশাপাশি সেই সময় একটা নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার যা আমায় চমকে দিয়েছিল। বিকেলের ঘুম দিয়ে উঠে এক সন্ধ্যায় আবিষ্কার করলাম বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ভাড়া বাড়ি। আশপাশের ঘরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সবাই গেছে বড় মাঠে, নাটক দেখতে। আমিও ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির। দেখি, নাটক শুরু হয়ে গেছে, মাঠ চুপচাপ শুনছে। বাড়ির কাউকে খুঁজে পাওয়ার অবস্থা নেই। আমি একেবারে সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম । সে এক অদ্ভুত নাটক। গল্প এগোচ্ছে। মঞ্চটা একটা ঘর। মঞ্চে চরিত্ররা ঘোরাফেরা করছে, কথা বলছে আর টুকটুক করে একটার পর একটা দেয়ালের টুকরো পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে মঞ্চের পুরো পিছনটা জুড়ে একটা গোটা দেয়াল বানিয়ে ফেলছে! মঞ্চ-ঘরের পিছনে দাঁড়ান সেই দেয়ালটায় পর্দা টাঙান জানালা আছে, প্রতি দুই জানালার মাঝে খোলা-বন্ধ হয় এমন আসল দরজা আছে। জানালা দিয়ে লোকেরা কথা বলছে। দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসছে, ঘর থেকে বাইরে যাচ্ছে!

কি নাটক ছিল সে প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি কারণ শুনেছিলাম সেটা বড়দের নাটক। বড় হয়ে খোঁজ নিয়ে মনে হয়েছে সেটি ছিল কেয়া চক্রবর্ত্তী অভিনীত নান্দীকারের নাটক – ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’, সম্ভাবনা, নিশ্চিত নই। যারা সেই নাটক দেখেছেন তারা হয়ত সঠিক বলতে পারবেন। সে নাটকের নানা টুকরো ছবি আজো গেঁথে আছে স্মৃতির নানা স্তরে। মঞ্চসজ্জার পাশাপাশি এই নাটক আমাকে উপহার দ্যায় আরো এক আশ্চর্য সন্ধান – নায়িকার অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্ব-র সাথে তখনো যুক্ত হয়নি নিজের কোন ভাল লাগা-মন্দ লাগা, কিন্তু চেতনার কোন আবছা স্তরে বড় মেয়েদের আবিষ্কার করি মেয়ে হিসেবে। বড় হয়ে যাই আরো একটু।

ইতিমধ্যে ঘটে গেল এক কান্ড। এই ঘটনাটার সঠিক সময়কাল এখন খানিকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে এই পর্বেই অর্থাৎ তিন থেকে সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে ঘটেছিল। বাবা আমি আর আমার পিঠোপিঠি মেজ ভাই তিন জনে মিলে মেলায় বেড়াতে গেলাম। মেলায় বেলুনওআলা বানিয়ে চলেছে নানা আশ্চর্য – কুকুর, মালা, মুকুট আরও কত কি! মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি আমি। এক সময় আবিষ্কার করি – আমি হারিয়ে গেছি। বাবা-ভাই কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবে ভয় করে নি আমার। চারপাশে এত লোক! উপায় হয়ে যাবে কিছু একটা। কিন্তু কি ভাবে! মাথায় যে কিছু আসছে না! এবার হতাশায় চোখে জল চলে আসে আমার!

হঠাৎ এগিয়ে আসে এক কাকু। প্রশ্ন করে করে বোঝার চেষ্টা করে বাড়ি কোথায় আমার। আমি যতটা পারি বলি। তারপর দুজনে মিলে রওনা হই বাড়ির উদ্দেশ্য। চলতে চলতেই মিলিয়ে নিতে থাকি পথ – হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই দিকে, এই ব্রীজ দিয়ে রেললাইন পার হতে হবে। এবার এই দিকে। একসময় বাড়ি এসে গেল। কাকুটা আমায় বলল, সাহসী ছেলে, ভাল ছেলে। আর সাহসের পুরস্কার হিসাবে আমায় একটা পয়সা দিল। সম্ভবত: পঞ্চাশ পয়সা ছিল সেটা। বাড়ির দরজায় আমায় পৌঁছে দিয়ে কাকুটা তার বাড়ি চলে গেল। আর, আমি বুক পকেটে পয়সা ভরে বিজয় গর্বে বাড়ি ঢুকে এলাম।

মা তো আমার কাছে ঘটনা শুনে আঁতকে উঠল। তারপর জিজ্ঞেস করল নাম কি সে কাকুর, সে কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? আমি বললাম – নাম জানি না, ভাল কাকু, বাড়ি চলে গেছে। মা অত্যন্ত হতাশ হয়ে জানাল এমন উপকারী মানুষের নাম না জানাটা আমার অত্যন্ত বোকামী হয়েছে। আর, এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম কি অসাধারণ বেকুব ছেলে আমি! সেই সাথে মা-ঠাকুমা দুজনেই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল বাবার অবস্থা ভেবে। তারা কথা বলতে বলতেই বাবা এসে পড়ল ভাইকে নিয়ে। আমায় দেখতে পেয়ে নিশ্চয়ই বিরাট এক আনন্দ হয়েছিল তার। কিন্তু মুখ দেখে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। মার কাছ থেকে খুঁটিয়ে সব জেনে নিয়ে আমায় বলল – “চল।” ভাই বাড়িতে রইল। আমি চললাম বাবার সাথে – কোথায় কে জানে!

এ পথ সে পথ ঘুরে বাবা যেখানে আমায় নিয়ে এল তা দেখে আমি আর আমাতে নেই! চারিদিকে খাকি পোষাক। থানা। দারোগা টেবিলে বসে কি লিখছে। বাবা গিয়ে সামনে দাঁড়াল। আমার সামনেই গরাদ ঘেরা কি জায়গা ওটা? কি আবার? জেলখানা। জেলখানা ছাড়া আর কি হবে? বাবা কি যেন বলল দারোগাকে। আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। দারোগা ফিরল আমার দিকে। সব বুঝে গেছি আমি। বাবা আমায় শাস্তি দিচ্ছে। দারোগা এবার আমায় জেলে ভরে দেবে। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। বাবা ত থ। এত ঘুর-চক্কর খেয়ে যে ছেলের কোন উদ্বেগ দেখা গেল না এখন তার কি হল? আর কি হল। আমার হেঁচকি উঠতে রইল। অপ্রস্তুত বাবা কোনমতে কি সব সই-টই করে আমায় নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে এল। বাবা যে কি সব বলে যাচ্ছিল – ডাইরী, জানিয়ে যাওয়া – এতক্ষণে একটু একটু করে আমার মাথায় ঢুকতে শুরু করল। আর তার পরে লজ্জায় মাথাটা আমার নীচে, আরো নীচে নেমে যেতে রইল। সে’দিন আমি ভয় আর লজ্জা দুটোর-ই মুখোমুখী হয়েছিলাম এমন তীব্রতায় যা এর আগে আর কখনো ঘটেনি। পরে বহুবার ঘটেছে। সেই দিনটা ছিল সূচনা বিন্দু। জীবন-নাটকের কঠিনতর অধ্যায়-এর ।

দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকতে থাকতেই বাবা তাঁর সরকারী চাকরীতে বদলী হয়ে গেলেন উত্তর বঙ্গে। আমার স্কুলের বছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাঁর কাছে যেতে পারলাম না। তিন সন্তান আর প্রতাপান্বিত বিধবা শাশুড়ি নিয়ে মা কি করে একা সামলেছিল সেই দিনগুলো ভাবলে আজো আশ্চর্য লাগে। তবে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখি যে সমাজের নানা মানুষদের নানা ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি সে সময়। অর্ধ শতাব্দী পার করেও তাঁদের মহানুভবতার নানা টুকরো ছবি ভেসে যায় মাঝে মাঝে।